কক্সবাজারের উন্নয়নঃ গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় মাস্টার প্ল্যান by তোফায়েল আহমদ

সুন্দর ও পরিকল্পিত পর্যটন নগরী গড়তে কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত ৮০ হাজার একর জমি নিয়ে ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (মাস্টার প্ল্যান) চূড়ান্ত করেছে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর। গত কয়েক মাস আগে এই মাস্টার প্ল্যানের অনুমোদন দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এখন শুধু গেজেট প্রকাশের কাজটি বাকি আছে।


২০১১ সালের ১১ মে এই মাস্টার প্ল্যানের খসড়া প্রকাশ করেছিল নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর। মাস্টার প্ল্যানের অগ্রগতি বিষয়ে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, মাস্টার প্ল্যানের কাজটি গত কয়েক মাস আগে মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। গেজেট প্রকাশের পর ২০ বছর মেয়াদি এই মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করবে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারে পর্যটনশিল্পের প্রসার শুরু হয় এক যুগ আগে। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আগমনে মুখরিত কক্সবাজারে দেখা দেয় আবাসন, বিনোদনসহ নানা সংকট। আর এ সুযোগে পর্যটকদের সুবিধা দিতে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত গড়ে উঠে শত শত বহুতল ভবন। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে কক্সবাজার সাগরপাড়কে হোটেল মোটেল জোন ঘোষণার মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় 'বিএনপি পল্লী'। আর সেখানে পরে গড়ে তোলা হয় বহুসংখ্যক অপরিকল্পিত অট্টালিকা।
হোটেল মোটেল জোনের পূর্ব পাশে গণপূর্ত বিভাগের আবাসিক এলাকায় শতাধিক গেস্ট হাউস বাণিজ্যিকভাবে হোটেল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় যেখানে দুইটি পাঁচ তারকা মানের হোটেল নেই, সেখানে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে এক ডজনেরও বেশি পাঁচ তারকা মানের হোটেল। নির্মিত হচ্ছে আরো বেশ ক'টি হোটেল। এছাড়া স্টুডিও টাইপ তিন তারকা ও পাঁচ তারকা মানের অ্যাপার্টমেন্টও রয়েছে অর্ধশতাধিক। এসব নির্মাণে কক্সবাজারে বর্তমানে ৫৭ টি ডেভেলপার কম্পানি কাজ করছে বলে জানা গেছে।
দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ফলে কক্সবাজার একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপ নিতে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে কোন ধরনের মাস্টার প্ল্যান না থাকায় পুরো কক্সবাজারেই অপরিকল্পিত নগরায়ণ শুরু হয়। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বেসরকারি সংস্থা শেলটেক কনসালটেন্ট যৌথভাবে মাস্টার প্ল্যান তৈরির উদ্যোগ নেয়। প্রায় দুই বছর কাজ করার পর গত ১১ মে মাস্টার প্ল্যানের খসড়া প্রকাশ করে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর। 'প্রিপারেশন অব ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান অব কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি- বিচ আপ টু টেকনাফ' নামক প্রকল্পের আওতায় এ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়।
মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান শেলটেক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালী পৌরসভা ও আদিনাথ মন্দির এলাকা থেকে শুরু করে কক্সবাজার পৌরসভা, কক্সবাজার সদর উপজেলার একাংশ, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে টেকনাফ সৈকত পর্যন্ত এলাকা, রামু ও উখিয়া উপজেলার একাংশ, টেকনাফ পৌরসভা এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় ৮০ হাজার একর জমি নিয়ে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে।
খসড়া মাস্টার প্ল্যানে পুরো কক্সবাজারকে নয়টি গুরুত্বপূর্ণ জোনে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলে মহেশখালী ইকোনমিক অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল জোন, কক্সবাজার সিটি ডেভেলপমেন্ট এরিয়া, হিমছড়ি মাল্টিকালচার ট্যুরিস্ট জোন, ইনানী এঙ্ক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন, হোয়াই্যকং ইকোনমিক জোন, নাফ ট্যুরিস্ট জোন, টেকনাফ ট্যুরিস্ট জোন, শাহপরীর দ্বীপ ট্যুরিস্ট জোন এবং ইকোলজিক্যাল ক্রিটিকেল জোন। এসব জোনে রাখা হয়েছে- আরবান রেসিডেন্সিয়াল জোন, কর্মাশিয়াল জোন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, মিঙ্ড ইউজড জোন, এডমিনিস্ট্রেটিভ জোন, রূরাল সেটেলমেন্ট জোন, ওপেন স্পেস, অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড প্রাইমারি অ্যাক্টিভিটি জোন, লো টাইডাল জোন, ট্যুরিস্ট ফ্যাসিলিটিজ জোন, বিচ রিক্রিয়েশন জোন, ইনস্টিটিউশনাল জোন, ফরেস্ট অ্যান্ড ভেজিটেশন জোন, ওয়াটার বডি এবং রেসটিক্টেট জোন। এছাড়া মাস্টার প্ল্যানে সৈকত থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা না করা, ৫০০ থেকে ১০০০ মিটারের মধ্যে ১৫ ফুট উচ্চতার কটেজ সিস্টেম, ১০০০ মিটার থেকে ১৫০০ মিটার পর্যন্ত ৫০ ফুট উচ্চতা, ১৫০০ মিটার থেকে ২০০০ মিটার পর্যন্ত ৭০ ফুট উচ্চতা, ২ হাজার মিটার থেকে ২৫০০ মিটার পর্যন্ত ১১০ ফুট উচ্চতা ও ২৫০০ মিটার থেকে ৩০০০ মিটার পর্যন্ত ১১০ ফুট এর বেশি উচ্চতার স্থাপনা নির্মাণ করার বিধান রাখা হয়েছে।
এই বিধানের ফলে ইতোমধ্যে সৈকতের ৫০০ মিটারের মধ্যে গড়ে উঠা অসংখ্য বহুতল ভবনের ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে বিতর্ক। এর মধ্যেই গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভায় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত মাস্টার প্ল্যান তৈরির কাজ শুরু করে। গেল বছরের জুন মাসে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
খসড়া প্ল্যানে কক্সবাজারের মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় ছয় লাখ লোক অধ্যুষিত ৩৩ টি মৌজার ৭৯ হাজার ৬৫৭ একর জমি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্ল্যান প্রণয়নকারী প্রকল্পের টিম লিডার ড. নুরুল ইসলাম নাজেম এক সেমিনারে জানিয়েছিলেন, প্রকল্পটিতে দুই স্তর বিশিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম স্তর হচ্ছে স্ট্র্যাকচার প্ল্যান ২০ বছর (২০১১-২০৩১) এর আওতায় কাঠামো পরিকল্পনা নীতি ও কৌশল নির্ধারণপূর্বক পরবর্তী পরিকল্পনার অবকাঠামো ও দিকনিদের্শনা। আর দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে ৫-১০ বছর (২০১১-২০২০) এর আওতায় বিস্তারিতভাবে নির্দিষ্ট এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণ। তিনি আরো বলেছিলেন, কক্সবাজার অঞ্চলের এই মহাপরিকল্পনা আগামী ২০ বছর কক্সবাজার শহর, সমুদ্রসৈকত এলাকা, মহেশখালী, টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন অঞ্চলে উন্নয়ন প্রসারণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে পুরো অঞ্চলটি হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যযুক্ত একটি আদর্শ উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির এলাকা।
কিন্তু কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ না থাকায় পর্যটন শহর কক্সবাজারের এ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নকারী সংস্থা কে হবে তা নিয়ে সংশয় ছিল। অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) খসড়া আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এদিকে গত ১০ মাস ধরে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ এর ৪(১) ধারা মোতাবেক কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে গঠিত ৭ সদস্যের একটি কমিটি কক্সবাজারের সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তবে উক্ত কমিটির কাছে পূর্ণাঙ্গ কোনো ক্ষমতা না থাকায় অনেক কিছুই তারা করতে পারছেন না। এ কমিটি কেবল শহরে অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত দিতে পারলেও সৈকত ও মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন এলাকায় কোনো অবকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। কমিটির কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব এলাকা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে গণ্য হবার কারণে তারা নানা জটিলতার সম্মুখীন হন।
অন্যদিকে কক্সবাজারে বিনিয়োগকারী ডেভেলপার্স কম্পানিগুলো তাদের স্থাপনাগুলোর ডিজাইন অনুমোদন দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যমান থাকা কমিটি নানা সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে যত্রতত্র স্থাপনার অনুমোদন দিতে পারছে না বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এবং কক্সবাজারের উন্নয়ন তদারকির জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেছেন, 'পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা না থাকায় এক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর পরেও কক্সবাজারের স্বার্থে আইন অনুসারে ইতোমধ্যে ৫৭টি ডেভেলপার্স কম্পানির নিবন্ধন, ১০টি ডেভেলপার্স কম্পানির অবকাঠামো ডিজাইন অনুমোদন ও ৭টি ব্যক্তি মালিকানাধীন অবকাঠামো অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।'
Share on Google Plus

প্রতিবেদনটি পোষ্ট করেছেন: Unknown

a Bengali Online News Magazine by Selected News Article Combination.... একটি বাংলা নিউজ আর্টিকেলের আর্কাইভ তৈরীর চেষ্টায় আমাদের এই প্রচেষ্টা। বাছাইকৃত বাংলা নিউজ আর্টিকেলের সমন্বয়ে একটি অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিন বা আর্কাইভ তৈরীর জন্য এই নিউজ ব্লগ। এর নিউজ বা আর্টিকেল অনলাইন Sources থেকে সংগ্রহকরে Google Blogger এর Blogspotএ জমা করা একটি সামগ্রিক সংগ্রহশালা বা আর্কাইভ। এটি অনলাইন Sources এর উপর নির্ভরশীল।
    Blogger Comment
    Facebook Comment