তামাকের রাজ্যে ফুল by পুষ্পেন চৌধুরী

কক্সবাজারের চকোরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় তামাকের চাষ হয়।
ক্ষতি জেনেও চাষিরা দীর্ঘদিন ধরে তামাকের আবাদ করে আসছেন।

তবে বছর কয়েক ধরে উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নে ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে।
সারি সারি তামাকখেতের মাঝে গোলাপ, গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা ফুলের চাষ করছেন কিছু চাষি। তামাক চাষে লাভ বেশি। ফুল চাষেও কম নয়। বরং তামাক জমির উর্বরতা কমায়, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ায়। তাই বরইতলীর সচেতন অনেক চাষি এখন ফুলের চাষ করছেন।
এমনই একজন সিরাজুল ইসলাম। গোলাপ ও গ্ল্যাডিওলাসের চাষ করে দিন বদলেছেন। তিনি শিক্ষকতা করেন উত্তর বরইতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তাঁকে দেখে এলাকার অনেকে ফুল চাষে উৎসাহী হয়েছেন।
শুরুটা যেভাবে: স্বাবলম্বী হওয়ার চিন্তা থেকে ফুলের চাষ শুরু করেন সিরাজুল। বাড়ি তাঁর উপজেলার পূর্ব বড় ভেউলা গ্রামে।
সিরাজুলের শুরুর গল্পটা এ রকম: ২০০২ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জাহাঙ্গীর কবির বরইতলীতে গোলাপের চাষ করতেন। তাঁর কাছে ফুল চাষের হাতেখড়ি। জাহাঙ্গীর কবির বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর শেখানো পথ ধরে অনেক দূর এগিয়েছেন সিরাজুল। বরইতলীতে ২৮০ শতাংশ জমি নব্বই হাজার টাকায় পাঁচ বছরের জন্য ইজারা নেন। ওই জমিতে একসময় তামাকের চাষ হতো। ওই বছরই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কসংলগ্ন ওই জমিতে গোলাপ (আমেরিকান মেরিন্ডা) ও গ্ল্যাডিওলাসের চাষ শুরু করেন। সার, চারা ও শ্রমিক মিলে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। শুরুর বছর খুব একটা লাভ হয়নি।
পরের বছর থেকে লাভের মুখ দেখা শুরু করেন। বর্তমানে গোলাপের কলমের চারা তিনি বরইতলী নার্সারি থেকে এবং গ্ল্যাডিওলাসের চারা ঢাকা ও যশোর থেকে সংগ্রহ করেন। ফুল চাষে এখন সিরাজুলের সাত-আট লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে। নারী-পুরুষ মিলে তাঁর বাগানে ১৪ জন শ্রমিক আছেন।
সিরাজুল জানান, নভেম্বর-ফেব্রুয়ারির দিকে ফুলের উৎপাদন ভালো হয়। চাহিদাও থাকে প্রচুর। গোলাপের চারা রোপণের দুই মাস পর ফুল ধরে। গ্ল্যাডিওলাসের চারা রোপণের ৬০-৭০ দিনের মাথায় ফুল বিক্রি করা যায়। একটি গোলাপ গাছ তিন-চার বছর ফুল দেয়। আর গ্ল্যাডিওলাস ফুল ফোটার ১৫-২০ দিনের মধ্যে বিক্রি করতে হয়।
ফুল চাষের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে সিরাজুল ক্যাপসিকাম, শসা, টমেটো ও শিমের চাষ করেছেন। গত বছর সাথি ফসল বিক্রি করে এক লাখ টাকা আয় হয়েছে তাঁর।
ফুল বাজারজাতকরণ: সিরাজুলকে দেখে বরইতলীর অনেকে এখন ফুলের চাষ করছেন। তাঁদের মধ্যে মইনুল ইসলাম, এজাহার আহমদ, মো. করিম, ওসমান গণি, এহসানুল হক, ইদ্রিচ, মো. ইউনুস, মো. এনাম, জায়েদুল ইসলাম, আবসারুজ্জামান রয়েছেন। এসব চাষির অনেকে আগে তামাকের চাষ করতেন।
চাষিরা জানান, প্রতিদিন বরইতলী থেকে গড়ে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। তাঁদের ভাষ্যমতে, সরকার যদি বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিত বা বাজার সৃষ্টিতে সহযোগিতা করত, তাহলে এখানে ফুল চাষের বিপ্লব হতো। তামাক চাষে নিরুৎসাহিত হতো অনেকে। পাশাপাশি ফুলচাষিদের প্রশিক্ষণ, সুলভ মূল্যে সার, বীজ ও ঋণ-সুবিধার দাবি জানান। বর্তমানে বরইতলী থেকে ফুল সারা দেশে পাঠানো হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় ও চাষিরা জানান, বর্তমানে চকোরিয়ায় ২২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি রয়েছে। আর বরইতলী ইউনিয়নে কৃষিজমি আছে দুই হাজার ৪৫ হেক্টর। উপজেলায় তামাকের চাষ হয় এক হাজার হেক্টরে। এর মধ্যে বরইতলীতে ১২০ হেক্টর জমিতে তামাকের আবাদ হয়। ওই ইউনিয়নে ফুলের চাষ হচ্ছে ৬১ হেক্টরে। এর মধ্যে গোলাপের চাষ হচ্ছে ৪০ হেক্টর, গ্ল্যাডিওলাস ২০ হেক্টর ও গাদা এক হেক্টর জমিতে।
লাভের খতিয়ান: বরইতলীতে প্রতিটি গোলাপ এক থেকে পাঁচ টাকায় বিক্রি হয়। পাশাপাশি গ্ল্যাডিওলাস প্রতিটি পাঁচ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়। চাষিরা জানান, গত বছর তাঁরা আট লাখ টাকার গোলাপ ও চার লাখ টাকার গ্ল্যাডিওলাস বিক্রি করেন। খরচ বাদে লাভ হয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। ফুলের উৎপাদন বাড়িয়ে এ বছর তা দ্বিগুণ হবে বলে আশাবাদী তাঁরা।
তামাক চাষিরা জানান, চকোরিয়ায় ৪০ শতাংশ জমিতে তামাকের চাষ করলে কোম্পানিগুলো বছরে ২০-২২ হাজার টাকা জমির মালিককে দেয়। এ ছাড়া সার, বীজ, কীটনাশকসহ সহজ শর্তে তামাকচাষিদের ঋণ দেওয়া হয়। ফুল, সবজি ও ধান চাষে এসব সুবিধা পাওয়া যায় না। আর্থিক সুবিধা ও দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে অনেকে তামাকের চাষ ছাড়তে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলেন: উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আতিকউল্লাহ জানান, তামাক জমির প্রচুর পুষ্টি শোষণ করে বিধায় জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। মাটির জৈব পদার্থের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি তামাক পুড়তে প্রচুর জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হওয়ায় আশপাশের বনাঞ্চল ধ্বংস হয়। ধান ও শাক-সবজির উৎপাদন হ্রাস পায়। তামাক পোড়ানোর ধোঁয়ায় শিশুদের শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, চর্মরোগ বাড়ে।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়া উদ্দিন বলেন, তামাকের বিষে বরইতলী তথা চকোরিয়ার বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে এখানে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ করা যাবে এবং বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।
Share on Google Plus

প্রতিবেদনটি পোষ্ট করেছেন: Unknown

a Bengali Online News Magazine by Selected News Article Combination.... একটি বাংলা নিউজ আর্টিকেলের আর্কাইভ তৈরীর চেষ্টায় আমাদের এই প্রচেষ্টা। বাছাইকৃত বাংলা নিউজ আর্টিকেলের সমন্বয়ে একটি অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিন বা আর্কাইভ তৈরীর জন্য এই নিউজ ব্লগ। এর নিউজ বা আর্টিকেল অনলাইন Sources থেকে সংগ্রহকরে Google Blogger এর Blogspotএ জমা করা একটি সামগ্রিক সংগ্রহশালা বা আর্কাইভ। এটি অনলাইন Sources এর উপর নির্ভরশীল।
    Blogger Comment
    Facebook Comment