কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও হ্নীলা এলাকার চাল ব্যবসায়ীদের ‘হয়রানি’ করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এমন অভিযোগ তুলে সীমান্তের চাল ব্যবসায়ীরা চালের চালান আনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এক সপ্তাহ ধরে চাল আনা বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে চালের দামও বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিজিবি সদস্যরা ‘পাচার’ অভিযোগে শুধু চালই আটক করছে না, একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের হয়রানিও করছে। এমনকি মোস্তাক আহমদ নামের এক চাল ব্যবসায়ীকে ‘পাচারে জড়িত সন্দেহে’ মামলায়ও ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টেকনাফ ও হ্নীলা এলাকার ১৯টি হাটবাজারের ব্যবসায়ীরা এক সপ্তাহ ধরে দেশের অন্য এলাকা থেকে চালের চালান আনা বন্ধ করে দিয়েছেন। হ্নীলার দুটি বাজারে ইতোমধ্যে চাল বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে বিজিবি দাবি করেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গার পর ওই অঞ্চলে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগে বাংলাদেশ থেকে চালসহ বিভিন্ন পণ্য ওপারে পাচার হচ্ছে। পাচার প্রতিরোধে তারা অভিযান চালাচ্ছেন। টেকনাফের হ্নীলা এলাকার চাল ব্যবসায়ীরা এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, মিয়ানমারে চাল পাচার হচ্ছে—এমন অভিযোগে বিজিবি টেকনাফ ও হ্নীলা এলাকার চাল ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছে। পাচারের জন্য মজুত করা হয়েছে—এই অভিযোগ তুলে বিজিবি সদস্যরা দোকান থেকেই চাল জব্দ করে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, শুধু ব্যবসায়ীদের নয়—সাধারণ মানুষকেও হয়রানি করছে বিজিবি। এক-দুই বস্তা চাল নেয়ার পথেও আটক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা টাওয়ার এলাকায় সংবাদ সম্মেলনে মৌলভী জামাল হোসেন বলেন, ‘বিজিবির দায়িত্ব হচ্ছে সীমান্তে পাচার হওয়ার সময় পণ্য জব্দ করা। অথচ বিজিবি দোকানে হানা দিয়ে চাল নিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘হ্নীলার লেদা প্রধান সড়ক থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত। অথচ প্রধান সড়কের কাছে এসে গত ২ জুলাই লেদার মুছনিপাড়া থেকে চাল ব্যবসায়ী সুলতান আহমদের দোকান থেকে ৪৫৭ বস্তা চাল ও ২৩ বস্তা ময়দা জব্দ করে নিয়ে যায় বিজিবি। ওই সময় দোকান মালিক সুলতান আহমদ ও কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে আটক করা হয়। ব্যবসায়ী নাজির হোসেন ও মৌলভী সাবের আহমদ জানান, বিজিবির এই হয়রানির কারণে চাল ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে যে চাল আনতেন তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
তারা বলেন, বিজিবি সীমান্ত থেকে কোনো ব্যবসায়ীকে চাল পাচারকালে ধরলে আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু প্রধান সড়কের ওপর দোকান থেকেই চাল আটক করা হচ্ছে। প্রকাশ্যেই ওই চাল রাখা হয়েছে। গোপনে কোথাও মজুত করা হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, যে এলাকা থেকে চাল আটক করা হয়েছে, সেই এলাকার মানুষ কেনা চালের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া ২৫-২৭ হাজার নন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গাও সেখানকার দোকান থেকে চাল কিনে নেন। প্রতিদিন ৫-৬শ’ বস্তা চালের চাহিদা রয়েছে হ্নীলা ও আশপাশ এলাকায়।
তাদের দাবি, চাষাবাদের জমিতে লবণ চাষ হওয়ায় সব অধিবাসীকেই কেনা চালের ওপর নির্ভর করতে হয়। এদিকে গত সোমবার সারাদিন কক্সবাজার ও টেকনাফে কর্মরত একদল সাংবাদিক সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, বিজিবির অভিযান আতঙ্কে হোয়াইক্যং, মিনাবাজার, খারাংখালী, হ্নীলা স্টেশন, টেকনাফ বাজার, সারবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, শীলখালী, শামলাপুরসহ উপজেলার ১৯টি হাটবাজারের ব্যবসায়ীরা দেশের অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে চালের চালান আনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এছাড়া বন্ধ হয়ে গেছে লেদা ও মোচনী হাটবাজারের চালের দোকানগুলো। এতে বাজারে গাজী ইরি, বক, কার্ড বেথি, মোটা বেথি, পাইজার, ভিয়েতনাম, পুরান বেথি চালের দাম বস্তাপ্রতি ৭০-৮০ টাকা হারে বেড়ে গেছে। টেকনাফ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এইচ এম ইউনুছ বাঙ্গালী বলেন, ‘চাল অবৈধ মাল নয়। যদিও বিজিবি পাচারকালে চাল আটক করতে পারে; কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত পাচার পয়েন্টে যায়নি ততক্ষণ মালামাল বৈধ।’ টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এন এম নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘মিয়ানমারে দাঙ্গার পর রাখাইন রাজ্যে চালসহ নিত্যপণ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সুযোগে সীমান্ত চাল যাচ্ছে এটা কিছুটা ঠিক। কিন্তু যারা অবৈধভাবে চালসহ পাচারযোগ্য পণ্য মজুত করেছে, তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বিজিবি।’ তিনি বলেন, ‘বিজিবির ধরার নিয়ম যেমন সীমান্ত পার হওয়ার সময়, তেমনি আবার বিজিবির আওতাভুক্ত এলাকা সীমান্ত থেকে ৮ কিলোমিটার। টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কও ওই ৮ কিলোমিটারের আওতায় পড়ে গেছে।’ ইউএনও দাবি করেন, গ্রেফতার হওয়া ব্যবসায়ী সুলতান আহমদের বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল না। খুচরা চাল বিক্রির যে কাগজ ছিল, তাও মেয়াদোত্তীর্ণ। নতুন করে নবায়নের কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেননি। বিজিবির টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সফিকুর রহমান বলেন, ‘টেকনাফ ইউএনওর পরামর্শ নিয়েই ওই ব্যবসায়ীকে ধরা হয়েছে। চালও দোকান থেকে আটক করা হয়নি, অন্যখানে আনলোড করার সময় চাল জব্দ করা হয়েছে।
তাছাড়া ওই ব্যবসায়ীর বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল না।’ ৪২ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদ হাসান সাংবাদিকদের জানান, সত্ ব্যবসায়ীদের পাশে বিজিবি সবসময় থাকে। তবে যেসব ব্যবসায়ীর ব্যাপারে চোরাচালানের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যাচাই-বাছাইয়ের পর চাল আমদানির লাইসেন্স পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
Blogger Comment
Facebook Comment