কক্সবাজারের রামুতে শনি ও রবিবার ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ঘটনাটিকে 'পরিকল্পিত' বলে জানতে পেরেছে এলাকাবাসী ও প্রশাসন। হামলাকারীদের বেশির ভাগ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগেই প্রস্তুতি নিয়ে দলে দলে ও ট্রাকে করে মিছিল নিয়ে এসেই উপজেলা সদরের বড়ুয়াপাড়ায় হামলে পড়ে।
বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ ঘরবাড়িতে ব্যাপক লুটপাটও চালানো হয়। আগুন লাগাতে ব্যবহার করা হয় গানপাউডার, পেট্রল এবং স্প্রে মেশিন। গতকাল সোমবার দিনব্যাপী রামু উপজেলা সদরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য।
অন্যদিকে রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন বিএনপির দুজন তৃণমূল পর্যায়ের নেতার নেতৃত্বে হামলাকারীর দল লট উখিয়ারঘোনা এলাকার আর্যবংশ বৌদ্ধবিহারটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন। ওই বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমল বড়ুয়া গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, বিএনপির ওই দুই নেতার নেতৃত্বে শনিবার রাতে মিছিলকারীরা দুই জ্যারিকেন কেরোসিন এনেছিল। আমিন নামের স্থানীয় এক গ্রামবাসী কেরোসিন এবং অছিউর রহমান নামের অন্য একজন গ্রামবাসী খড় এনে বিহারটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিহারের ১৫টি মূর্তির সবই পুড়ে গেছে আগুনে। বিহারটির পরিচালনা পরিষদের সদস্য দীপক বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, বিহারে আগুন দেওয়ার ঘটনায় যারা জড়িত, এ রকম ৪২ ব্যক্তির নাম-ঠিকানা রামু থানার পুলিশকে দেওয়া হয়েছে।
রামুর উত্তর মিঠাছড়ি বড়ুয়াপাড়ার প্রজ্ঞামিত্র বন বিহারের পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক টিটু বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে জানান, স্থানীয় তেচ্ছিপুলের শাহ আলম কোম্পানী নামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির নেতৃত্বে কয়েক শ লোকের একটি মিছিল থেকে গান পাউডার ও পেট্রল ঢেলে তাদের বিহারটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রামু উপজেলা সদরের বাসিন্দা শামীম আহসান ভুলু গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, শনিবারের সহিংস ঘটনার নেপথ্যে স্থানীয় মওলানা আবদুল হক নামে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এক ব্যক্তিও জড়িত। ওই ব্যক্তি স্থানীয় মুফতি হাবিবুল্লাহ নামের অন্য এক নেতাকে মোবাইল ফোন করার পরই ট্রাকে ট্রাকে লোকজন আসে রামু সদরে।
রামু উপজেলা সদরের বাসিন্দা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ কালের কণ্ঠকে জানান, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত লোকজনের সম্মিলিত প্রতিবাদ মিছিলে ঢুকে কৌশলে জামায়াতের লোকজনই ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে। রামুতে হামলার শিকার বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের অধিকাংশ লোকই বলেছেন, সেই রাতে যারা হামলা চালিয়েছে, তারা প্রায় সবাই ছিল অপরিচিত লোকজন।
রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্টতা : রামু উপজেলার লট উখিয়ারঘোনা নামক এলাকায় অবৈধভাবে বসবাসকারী বর্মাইয়া ইউনুস সওদাগর নামের একজন রোহিঙ্গার ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। ওই রোহিঙ্গা শনিবার রাতে নানা স্থান থেকে রোহিঙ্গাদের জড়ো করে হামলায় লেলিয়ে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। রামুর লট উখিয়ারঘোনা বড়ুয়াপাড়ার বাসিন্দারা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, রবিবার রাতেও লট উখিয়ারঘোনা পাহাড়ে রোহিঙ্গা ইউনুস তার দলবল নিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট রামু উপজেলার দারিয়ারদীঘি রোহিঙ্গা আরএসও মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তারকৃত ছয় জঙ্গি রোহিঙ্গাও শনিবারের সহিংসতায় জড়িত থাকার কথা বলেছে হামলার শিকার অনেকেই।
গান পাউডার কিভাবে এলো : হামলার ঘটনা পরিকল্পিত না হলে গান পাউডার ও স্প্রে মেশিন পাওয়ার কথা নয়। কেননা যারা হামলাকারী তারা আগেভাগেই দাহ্যকাজে ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ দাহ্য পদার্থ সংগ্রহ করে না রাখলে তাৎক্ষণিক এসব পাওয়ার কথাও নয়। আগে রামুতে পটকা বানানোর কাজে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে এখানে পটকা বানানোর কাজও বন্ধ। তদুপরি হামলাকারীদের সঙ্গে যারা আগুন দেওয়ার কাজে ছিল তাদের অনেকেই ছিল অপরিচিত মুখ- এসব তথ্য দিয়েছেন হামলার শিকার বড়ুয়াপাড়ারা বাসিন্দারা।
সেনাবাহিনীকে সময়মতো ডাকা হয়নি : রামু উপজেলা সদরের মাত্র দুই কিলোমিটার দূরেই সেনাবাহিনীর একটি গ্যারিসন রয়েছে। সেই গ্যারিসনের সেনারা যথাসময়ে গেলেও রামুর এত বিপুল পরিমাণের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হতো, রামুর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা এ রকমই মনে করেন। কিন্তু তাঁরাও ঘটনাস্থলে আসেন বিলম্বে। এ প্রসঙ্গে সেনা সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, সেনা সদস্যরা অনেক আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সিভিল প্রশাসন থেকে তাঁদের (সেনা) ডাকতে বিলম্ব হওয়ার কারণেই দায়িত্বে নামায় বিলম্বে ঘটে। একইভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চট্টগ্রামস্থ সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ জিল্লুল হক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার (বিজিবি) ফোর্সরা সেই দিন সন্ধ্যার পর থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল অপারেশনে বের হওয়ার জন্য। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সিভিল প্রশাসন আমাদের আগেভাগেই না ডাকায় এ রকম ম্যাসাকার হয়েছে। তিনি আরো বলেন, 'অনেক রাতে আমাদের ডাকার পর আমরা আসি, কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা-ই হয়ে গেছে।'
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের বিদায়ী জেলা প্রশাসক (গতকাল চট্টগ্রামে রওনা হয়েছেন সেখানকার জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দিতে) মোহাম্মদ জয়নুল বারী কালের কণ্ঠকে গতকাল সন্ধ্যায় জানান, আসলে শনিবার রাত ১২টার পরেই হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছিল। আমি তখনই সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য আহ্বান করি। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় তাদের পৌঁছতে বিলম্ব হয়।
উখিয়ায় হামলায় ছিল স্থানীয়রা : আমাদের উখিয়া প্রতিনিধি জানান, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকে বলেছেন, স্থানীয় বিএনপি সমর্থক আবদুস সালাম জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ আলম, মোহাম্মদ ইসহাক, রহমত উল্লাহর নেতৃত্বে তিন শতাধিক লোক অতর্কিত হামলা চালিয়ে পেট্রল দিয়ে পরিকল্পিতভাবে পশ্চিম মরিচ্যা দীপঙ্কুর বৌদ্ধবিহার জ্বালিয়ে দেয়।
একইভাবে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত লোকজন রবিবার রাত ২টার দিকে উখিয়ার রাজাপালংয়ের খয়রাতিপাড়া প্রজ্ঞামিত্র বৌদ্ধবিহারে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে লুটতরাজ চালায় বলে স্থানীয় অরুণ বড়ুয়া, রূপায়ণ বড়ুয়া ও আবদুর রহিমসহ অনেকেই বলেন। রেজুরকুল স্বধর্ম বিকাশ বৌদ্ধবিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি রায় মোহন বড়ুয়া, অধ্যাপক শাহা আলমসহ অনেকেই বলেন, রবিবার রাত ৯টার দিকে অতর্কিত হামলা চালিয়ে দুই-তিন শ লোক রেজুরকুল স্বধর্ম বিকাশ বৌদ্ধবিহারে ভাঙচুর চালিয়ে বুদ্ধমূর্তিসহ অন্যান্য স্থাপনা ও সম্পদ তছনছ করে লুটে নিয়ে যায়। রাজাপালং জাদিমুরা কিয়াং পরিচালনা কমিটির সভাপতি ঝুনু বড়ুয়া, অরুণ বড়ুয়া, বাবুল বড়ুয়াসহ অনেকেই বলেন, রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে দুই শতাধিক স্থানীয় লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ওই মন্দির ভাঙচুর, বুদ্ধমূর্তি তছনছ ও অন্যান্য স্থাপনা নষ্ট করে। একইভাবে রবিবার রাত ৮টার দিকে উখিয়ার পশ্চিম রত্না শাসনতীর্থ সুদর্শন বৌদ্ধবিহার, উত্তর বড়বিল বৌদ্ধবিহার, বেনুবন বৌদ্ধবিহার, পূর্ব ভালুকিয়া বৌদ্ধবিহারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালায়।
পটিয়ায় ওয়েস্টার্ন মেরিনের শ্রমিক : পটিয়া প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের পটিয়ায় রবিবার বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরের পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরেও ভাঙচুরের ঘটনায় সিসি ক্যামরার মাধ্যমে ধরা পড়ে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ২৫ শ্রমিক। গত রবিবার দুপুরে ওই শিপইয়ার্ডের তালা ভেঙে সহস্রাধিক শ্রমিক উপজেলার লাখেরা গ্রামে ঢুকে বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরে তাণ্ডব চালায়। স্থানীয় একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন নামে জামায়াতপন্থী সংগঠনের প্রভাবিত ওই শ্রমিকরা কোলাগাঁও ও লাখেরা এলাকার প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরে হামলা চালায়।
গতকাল কক্সবাজার থেকে পাঠানো প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একটি মৌলবাদী কুচক্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রামুতে সুপরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষকে উসকানি দিয়ে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। একটি চক্র রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে গোটা দেশেই অস্থিরতা তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি আর আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখেই তারা তাদের এই অশুভ পরিকল্পনার ছক এঁটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কক্সবাজারে অবস্থানরত পুলিশের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, রামু বা এই পাহাড়ি অঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সংখ্যা হাতেগোনা। এখানকার বসবাসকারীদের জীবনযাত্রার মানও আধুনিক বা উন্নত নয়। ফলে ইন্টারনেটে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার ঘটনা তারা জেনে বিক্ষুব্ধ হয়েছে- এটা ঠিক নয়। তাদের উসকানি দিয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠীর নেতারা।
Blogger Comment
Facebook Comment