আরাকানে দাঙ্গা, প্রাণহানি, কারফিউঃ ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কড়া নজরদারি

টেকনাফের নাফ নদের ওপারে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার পর সে দেশ থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় বাংলাদেশ সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

অতীতে বিভিন্ন সময় মিয়ানমার থেকে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার ব্যাপারেও সম্ভাব্য সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মিয়ানমার সরকার দেশটির আরাকান প্রদেশে সেনা পাঠিয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে সামরিক আইন কার্যকর করা হয়েছে এবং সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিনের সহিংসতায় আরাকানের বন্দর শহর মংডুতে হতাহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত অর্ধশতাধিক লোকের প্রাণহানির আশঙ্কা করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। প্রতিনিয়ত সেখানে গোলাগুলি হচ্ছে। রাত নামলেই মিয়ানমারের আরাকানে চালানো গুলির শব্দ নাফ নদের এপারে বাংলাদেশেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তি সীমানা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে গতকাল শনিবার সকালে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। নাফ নদের ওপারে আরাকানের বিস্তীর্ণ এলাকা বাংলাদেশের মোবাইল টেলিফোন নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে। তাই আরাকানে কোন সময়ে কী ঘটছে, তা মুহূর্তেই এপারে জানা সম্ভব। গতকাল সকালে আরাকানের মংডু শহরের ডা. নাজিমুদ্দিন ও ডা. নুরুল হক নামের দুজন জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতাও খুন হয়েছেন।
সেই সঙ্গে ভুচিদং এলাকার একটি ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে কয়েকজন শিক্ষককে পুড়িয়ে হত্যার খবরও এসেছে। প্রতিনিয়ত নানা অঘটনের সংবাদ এবং একের পর এক গুজবে সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার ও বান্দরবানে নতুন করে অস্থির পরিস্থিতিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, আরাকান রাজ্যে গত ৩ জুন দুপুরে সংঘটিত একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে বহু বছর পর নতুন করে জাতিগত সহিংসতা শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে নির্যাতিত, নিপীড়িত। মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। সীমান্ত এলাকার সূত্রগুলো জানিয়েছে, ৩ জুন তংগু নামক স্থানে রাখাইন সম্প্রদায়ের হাতে নিহত হয়েছিলেন তাবলিগ জামায়াতের অনুসারী ১০ মুসলিম। একটি মাইক্রোবাসে করে তাঁরা অন্যত্র যাওয়ার পথে উগ্র রাখাইন সম্প্রদায়ের হামলার শিকার হন। রাখাইনরা মাইক্রোবাসটিতে আগুন ধরিয়ে দিলে তাঁরা সবাই অগি্নদগ্ধ হয়ে মারা যান বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেই ঘটনার জের ধরেই গত শুক্রবার মিয়ানমারের আরাকানে দাঙ্গা নতুন মাত্রা পায়।
ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা : আরাকানের মংডু, ভুচিদং ও আকিয়াব এলাকায় শুক্র এবং শনিবার সকালে সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিকেল গড়িয়ে আসার পর গুলির মাত্রা কমেছে বলে জানা গেছে। শুক্রবার রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের সময় রাখাইন সম্প্রদায়ের চারজনের মৃত্যুর পরই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমনকি এ সময় সীমান্তরক্ষী (নাসাকা) বাহিনীর সঙ্গে থাকা কয়েকজন সেনা সদস্যও হতাহত হন। এ ঘটনার পর পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। রোহিঙ্গা ও রাখাইনরা পরস্পরের ওপর হামলা করতে থাকে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা বাড়িঘর, দোকানপাট এবং হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া ছুরিকাঘাতে এক নারীসহ কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হন।
টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা হারুন সিকদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সীমান্ত এলাকাজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে আবারো এপারে আসার ভয়ে সীমান্ত এলাকার মানুষ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে।
গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ : গত দুই দিনে মিয়ানমারে আহতদের বেশ কয়েকজন চিকিৎসার জন্য গোপনে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা গেছে। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে গতকাল শনিবার সকালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি হয়েছেন ছলিম (২৫) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক। তাঁর বাড়ি আরাকানের বলিবাজার এলাকায়। বুকে গুলিবিদ্ধ ছলিমের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে তিনি জানান, শুক্রবার দুপুরে রাখাইন সম্প্রদায়ের অস্ত্রধারী যুবকদের এলোপাতাড়ি গুলিতে বহু রোহিঙ্গা নর-নারী হতাহত হয়েছে।
পুলিশ গতকালই ছলিমকে আটক করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। মিয়ানমারের ভুচিদং এলাকার রোহিঙ্গা যুবক আজিমুল হক এবং নুরুল হকও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ দিয়ে গতকাল সকালে এপারে এসেছেন। গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন হাসপাতালে। এভাবে আরো অনেক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা : উখিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ঘুনধুম বিওপির (বর্ডার আউটপোস্ট) বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সুবেদার সোহরাব গতকাল দুপুরে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সারা রাত ঘুমাননি আমার জওয়ানরা। তাঁরা নিরবচ্ছিন্ন সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত রয়েছেন। কোনোভাবেই যাতে সীমান্তে অনুপ্রবেশ না ঘটে সে দিকেই আমাদের দৃষ্টি।'
তবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়নি।
ঘুনধুম সীমান্তের বাসিন্দা আবদুর রহিম কালের কণ্ঠকে উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, 'মিয়ানমার থেকে আবার যদি অনুপ্রবেশ ঘটে তাহলে আমাদের এই ছোট দেশটির বারটা বাজবে। এমনিতেই কমপক্ষে চার লাখ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ। তার ওপর যদি আবার নতুন করে অনুপ্রবেশ ঘটে তাহলে আমাদের অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে ব্যাপক নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।'
বিজিবির ১৭ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, গত ৩ জুন থেকেই সীমান্তে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেই থেকে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এমনকি সীমান্ত এলাকার লোকজনের চলাচল পর্যন্ত সীমিত রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত মোট ২৪৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে কক্সবাজারে ৭২ কিলোমিটার এবং বান্দরবানে ১৭৬ কিলোমিটার পড়েছে। ওদিকে মিয়ানমারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে টেকনাফের নাফ নদের হ্নীলা এলাকার রাখাইন পল্লীতে হামলার আশঙ্কায় সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। টেকনাফ থানার ওসি মাহবুবুল আলম কালের কণ্ঠকে জানান, সুযোগের অপেক্ষায় থাকা তৃতীয় পক্ষের হামলার আশঙ্কা থেকেই সেখানে পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবির পরিস্থিতি : উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে রোহিঙ্গারা আরাকানের সহিংসতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছিল। তবে উখিয়া থানার পুলিশ গিয়ে রোহিঙ্গাদের সেই চেষ্টা ভণ্ডুল করে দেয়। উখিয়া থানার ওসি অপ্পেলা রাজু নাহা জানান, রোহিঙ্গারা যখন তখন অঘটন ঘটাতে চায়।
গতকাল কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার জালাল উদ্দিন দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে বৈঠক করছেন, তাদের শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করছেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা (আরআরসি) সরকারের যুগ্ম সচিব ফিরোজ সালাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, দুটি শরণার্থী শিবিরেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কোনো শরণার্থীকেই শিবিরের বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
বাণিজ্য ও ট্রানজিট বন্ধ: টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দুই দিন ধরে বাণিজ্যের মালামাল ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। মালামাল বোঝাই তিনটি জাহাজ গতকাল বন্দরে এলেও তা খালাস হয়নি। ওদিকে মিয়ানমারের বন্দর শহর মংডু এবং টেকনাফের সঙ্গে ট্রানজিট নৌকাও দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এর ফলে নৌপথে দুই দেশের মধ্যে কোনো লোক পারাপার হচ্ছে না।
Share on Google Plus

প্রতিবেদনটি পোষ্ট করেছেন: Unknown

a Bengali Online News Magazine by Selected News Article Combination.... একটি বাংলা নিউজ আর্টিকেলের আর্কাইভ তৈরীর চেষ্টায় আমাদের এই প্রচেষ্টা। বাছাইকৃত বাংলা নিউজ আর্টিকেলের সমন্বয়ে একটি অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিন বা আর্কাইভ তৈরীর জন্য এই নিউজ ব্লগ। এর নিউজ বা আর্টিকেল অনলাইন Sources থেকে সংগ্রহকরে Google Blogger এর Blogspotএ জমা করা একটি সামগ্রিক সংগ্রহশালা বা আর্কাইভ। এটি অনলাইন Sources এর উপর নির্ভরশীল।
    Blogger Comment
    Facebook Comment