কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় লাইসেন্সবিহীন করাতকলের আগ্রাসনের কারণে রেহাই পাচ্ছে না সরকারের সংরক্ষিত বন সামাজিক বনায়নের গাছ।
উপজেলার আশপাশে ২২টি করাতকলে দিন-রাত প্রকাশ্যে চলছে সরকারি বনাঞ্চল ও সামাজিক বনায়নের কাঠ চেরাই। সংঘবদ্ধ কাঠ চোর ও সন্ত্রাসীরা মাসের পর মাস এসব অবৈধ করাতকল চালু রেখে বনাঞ্চলের অপূরণীয় ক্ষতিসাধনসহ পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করে আসছে। বনাঞ্চল নিধনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হচ্ছে এ অবৈধ করাতকলগুলো। যত্রতত্র অবৈধ করাতকল হওয়ায় সংঘবদ্ধ কাঠ চোরেরা সরকারের সংরক্ষিত বাগানের মূল্যবান গাছ কেটে করাতকলে চেরাই করে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনায়াসে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তারা অবগত থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বন বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল। উপজেলার হোয়ানক, কালারমারছড়া, শাপলাপুর, বড় মহেশখালী, কুতুবজুম ও পৌরসভা এলাকার গুটিকয়েক ব্যক্তির সংঘবদ্ধ একটি চক্র বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সরকারি বাগানের মূল্যবান কাঠ চেরাই অব্যাহত রেখেছে। সূত্রে জানা যায়, মহেশখালী উপজেলার রেঞ্জ অফিস ও বিটের অধীনে রয়েছে বিশাল পাহাড়ি বনভূমি। মহেশখালীর সংরক্ষিত এ বনাঞ্চলে হাজার হাজার কোটি টাকার মূল্যবান কাঠ ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অবৈধ করাতকল বসিয়ে সংঘবদ্ধ কাঠ চোরেরা প্রতিনিয়ত সংরক্ষিত বাগান ও সামাজিক বনায়নের মূল্যবান গাছ কেটে চেরাই অব্যাহত রেখেছে। করাতকলে সাইজ করা এসব কাঠ পাচার হচ্ছে নৌপথে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মহেশখালীর বনাঞ্চল থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে অর্ধ কোটি টাকার মূল্যবান কাঠ অবৈধ করাতকলে চেরাই করে পাচার হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা যায়, মহেশখালী উপজেলার গোরকঘাটায় ৪টি, বরুনা ঘাটে একটি, বানিয়ার দোকানে দুটি, নতুন বাজারে ৩টি, কুতুবজোমে দুটি, হোয়ানকে দুটি, নোনাছড়িতে ৩টি, কালারমারছড়ায় দুটি, ইউনুছখালীতে একটি, শাপলাপুর জেমঘাটে দুটিসহ মোট ২২টি অবৈধ করাতকল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৫-৭টি করাতকলের বৈধ লাইসেন্স থাকলেও বাকি সব করাতকল সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গাছ কেটে সাবাড় করছে। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা কিছু বনদস্যু এসব করাতকলের অঘোষিত মালিক। এ ছাড়া বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা, হেডম্যান ও ভিলেজাররা স্থানীয় বন বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিট কর্মকর্তা এবং বন প্রহরীদের ম্যানেজ করে অবৈধ করাতকলগুলো স্থাপন করছে। পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, অবৈধ করাতকলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে কিছু লোক লাভবান হলেও বৃহৎ জনগোষ্ঠী তথা সরকারের ক্ষতি হচ্ছে বেশি। জনস্বার্থ এবং সরকারি সম্পদ রক্ষার স্বার্থে অবিলম্বে এসব অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সচেতনমহল। অন্যথায় মহেশখালী উপজেলার বনভূমি বিরানভূমিতে পরিণত হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে সরকারি বনের ছোট-বড় সব বৃক্ষ উজাড় হওয়ার পর সামাজিক বনায়নের গাছপালাও শেষ হয়ে যাবে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিছিন্ন হলেও দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর পাহাড়ে অতীতের নানা রকম জীবজন্তু হাতি, বাঘ, হরিণ, বানর, ভল্লুক, সাপ, অতিথি পাখির চারণভূমি ছিল। এমনকি কালারমারছড়াতে হাতির খেদা (হাতি ধরার ফাঁদ) ছিল। রোহিঙ্গাসহ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নির্বিচারে বনভূমির বৃক্ষ নিধন এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার চোরা দৃষ্টিতে মহেশখালীর পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বড় বৃক্ষে ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বন উজাড়ের ফলে জীববৈচিত্র্য পরিবেশ ধবংসের মুখে। অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের কিছু হেডম্যান ও ভিলেজার স্থানীয় বন বিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিট কর্মকর্তা এবং বন প্রহরীদের ম্যানেজ করে অবৈধ করাতকলগুলো স্থাপনে উৎসাহিত করেছে। করাতকলের এক ম্যানেজার জানান, বন বিভাগের লোকজন সপ্তাহ ও মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে এসব অবৈধ করাতকলগুলো চালানোর অনুমতি দিয়েছে। জানা গেছে, করাতকলের মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এদিকে উপজেলার পাহাড় নেই এমন ইউনিয়নেও ২-৩টি করাতকল স্থাপন করে পাহাড়, সামাজিক বনায়নের ও বেড়িবাঁধে সরকারের রোপণ করা বৃক্ষ উজাড় করা হচ্ছে। গত ২-৩ বছরের মধ্যে উপজেলায় অধিকাংশ অবৈধ করাতকল স্থাপন হলেও বন বিভাগের ভূমিকা দর্শকের মতো। বিগত কয়েক মাস আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম কাউছার হোসেন তিনটি করাতকল উচ্ছেদ করার পর মালিকরা হাজতবাস করে জামিনে মুক্ত হয়ে ফের তা চালু করে বলে সূত্রে প্রকাশ। এ ব্যাপারে উপজেলার রেঞ্জ কর্মকর্তা বজলুর রহমান জানান, পর্যায়ক্রমে এসব অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করা হবে।
Blogger Comment
Facebook Comment