সম্প্রীতির শহর রামুতে সংঘটিত স্মরণকালের জঘন্যতম ঘটনার নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ডদের এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা।
তবে ইন্ধনদাতা হিসেবে স্থানীয় বিএনপিদলীয় এমপি লুৎফর রহমান কাজলকে এ ঘটনায় ফাঁসাতে যাচ্ছে পুলিশ। এ জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছে তারা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, ভিডিও ফুটেজ ও মোবাইলে তোলা স্টিল ছবি দেখে মামলার আসামি করা হচ্ছে স্থানীয় আরও কয়েক জনপ্রতিনিধিকেও। কারণ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শ'খানেক দুষ্কৃতকারী তাদের সামনে রেখেই মন্দির পোড়ানোর এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। এদিকে উসকানি ও হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজনের নাম-ঠিকানার তালিকায় র্যাব ও পুলিশের কাছে সরবরাহ করেছে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধরা। ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে মিলিয়ে এখন তাদের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে নিশ্চিত হচ্ছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শনিবার রাত ১০টায় রামুর চৌমুহনী চত্বরে পুলিশ যখন একটি সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তখন অপর চারটি ইউনিয়নে সংগঠিত হয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সামনে রেখে তারা খণ্ড খণ্ডভাবে মিছিল বের করে। যাতে একটি মিছিল বাধাগ্রস্ত হলেও নাশকতা চালাতে পারে তারা অপর মিছিল থেকে। পরিস্থিতি না বুঝে স্থানীয় কয়েকজন মেম্বার মসজিদের মাইকে মানুষকে একত্র হওয়ার নির্দেশনা দেওয়ায় দুর্বৃত্তদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়েছে। কমপক্ষে সাত ভাগে বিভক্ত ছিল দুষ্কৃতকারীরা। এদিকে প্রশাসনকে সমাবেশে ব্যস্ত রেখে দুর্বৃত্তরা চাকমারকুল ইউনিয়ন, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থীদের জড়ো করে মন্দির অধ্যুষিত ইউনিয়নে। এরই মধ্যে উপজেলা এলাকায় প্রবেশ করে ২০-২৫টি মোটরসাইকেল। রামু-কক্সবাজার রোড ব্যবহার করে আসা মোটরসাইকেল আরোহীরা চৌমুহনী চত্বর থেকে আলাদা হয়ে যায়। মোবাইলে তোলা স্টিল ছবি, ভিডিও ফুটেজ ও গত তিনদিনে গ্রেফতার করা ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি থেকে পরিকল্পিত নাশকতার এমন ছক সম্পর্কে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
আসামি হচ্ছেন এমপি!
রামুর ঘটনায় ফেঁসে যেতে যাচ্ছেন স্থানীয় এমপি লুৎফর রহমান কাজল। এ প্রসঙ্গে পুলিশ স্পষ্ট করে কিছু না বললেও কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহেও পাওয়া যাচ্ছে এমন ইঙ্গিত। স্থানীয় সংসদ সদস্যকে মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'অন্যায়কারী যত প্রভাবশালীই হোক তাকে আইনের আওতায় আনব আমরা। এজন্য সরকার থেকেও নির্দেশনা দেওয়া আছে।' আবার ভিডিও ফুটেজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভুল বুঝিয়ে একটি পক্ষ বিহার পোড়ানোর কাজ সম্পন্ন করেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে কয়েকজন জনপ্রতিনিধিকে চিহ্নিতও করেছি আমরা।'
রামু পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও নাশকতার ঘটনায় এমপি ও জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ত থাকার ইঙ্গিত দিয়ে যান। আবার গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে এসে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া বলেন, 'এ নাশকতায় যদি মন্ত্রী-এমপিরাও জড়িত থাকেন তাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না।' রামুতে এসে একই ইঙ্গিত দিয়ে যান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবউল আলম হানিফও।
এ ব্যাপারে এমপি লুৎফর রহমান কাজলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, 'সরকারের মন্ত্রীরা তো তদন্তের আগেই আমাকে আসামি করে ফেলেছে। বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেওয়া যদি আমার অপরাধ হয়, তবে একই অপরাধে তো আসামি হওয়ার কথা আওয়ামী লীগের অনেককেই।' রামুর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেও এমপি কাজল নিজেকে নির্দোষ দাবি করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে অনুরোধ জানান। একই বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি সংবাদ সম্মেলন করেও।
কেন টার্গেট এমপি
শনিবার রাতে বিক্ষোভ নিরসন করতে চৌমুহনী চত্বরের সমাবেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা এক মঞ্চে বক্তব্য রাখলেও এমপির সঙ্গে ২০-২৫টি মোটরসাইকেলে করে কক্সবাজার থেকে সমর্থক আসার বিষয়টি ভিন্নভাবে নিয়েছে প্রশাসন। অনেকের অভিযোগ এ মোটরসাইকেল আরোহীরাই গান পাউডার ও স্প্র্রে মেশিন এনে আগুন লাগাতে সাহায্য করেছে বিক্ষোভকারীদের। মোবাইলে তোলা স্টিল ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে কয়েকজন মোটরসাইকেল আরোহীকে চিহ্নিতও করেছে পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে এ মুহূর্তে তাদের নাম প্রকাশ করছে না পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েই পুলিশ আসামি করতে পারে স্থানীয় এমপিকে। তবে স্থানীয় বিএনপি দলীয় নেতারা মনে করছেন কক্সবাজারে বিএনপিকে নেতৃত্ব শূন্য করতেই হামলা-মামলায় সরকার আসামি করতে পারে স্থানীয় এমপিকে। এ প্রসঙ্গে রামু উপজেলা বিএনপি সভাপতি আহমেদুল হক চৌধুরী বলেন, 'কক্সবাজার সদর-রামু উপজেলা থেকে বার বার বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তাই স্থানীয় এমপিকে আসামি করে বিএনপিকে নেতৃত্ব শূন্য করার পাঁয়তারা করছে সরকার।'
বৌদ্ধদের তালিকায় অভিযুক্ত যারাঃ
হামলা, ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের সঙ্গে জড়িত কয়েক সন্দেহভাজনের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন। তালিকা অনুযায়ী অভিযুক্তরা হলেন_ ছিরামুরা, চাকমারকুলের আবুল কাশেম ও আবদুস মাসুদ। শ্রীধনপাড়া, ফতেখাঁরকুলের দেলোয়ার হোসেন, আমতলীয়াপাড়ার জহির আহমদ, পূর্ব মেরংলোয়া, ফতেখাঁরকুলের দিদারুল আলম দিদার, মধ্যম মেরংলোয়ার আজিজ ও জহির আহম্মদ, ভূতপাড়া, ফতেখাঁরকুলের গিয়াসউদ্দিন, রামু বাজারের হাফেজ আহমদ, দক্ষিণ শ্রীকুলের মিজান মেম্বার, ফতেখাঁরকুলের সাফী, নূরুল উল্লাহ, রাজাকার মোহাম্মদ, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মৌলভী, কাউয়ারখোপের মৌলভী শফিক আহাম্মদ, নূর আহম্মদ, পশ্চিম গনিয়াকাটা লামারপাড়ার হাফেজ হাবিবুল্লাহ, লামারপাড়ার স্কুলপাহাড়ের ফরিদ আহাম্মদ, রশিদ আহাম্মদ, মহিউদ্দিন, নুর আহাম্মদ, মৌলভী আবদুর রশিদ, আবুল ছৈয়দ, গনিয়াকাটার হানিফ, ছবি্বর আহমদ, লট উখিয়ারঘোনার বদিউল আলম, রাহামত উল্লাহ, উখিয়ারঘোনা বড়ূয়াপাড়ার আবদুল কাদের, জাফর আলম, তচ্ছাখালীর আবদুছ ছালাম, সৈয়দ আলম, টেইলাপাড়ার মৌলভী নুরুল ইসলাম, উখিয়ারঘোনা সওদাগরপাড়ার আবদুল্লাহ, সেয়াফত আলী, হেলাল, ফজল, ওয়াদুল, সাদ্দাম হোসেন, রমজান আলী, উখিয়ারঘোনার স্কুলপাহাড়ের ওসমান গনি, সাতঘরিয়াপাড়ার মোজাফ্ফর আহমদ, আমিনুল কবির, শফিউল কবির ও সরওয়ার আলম।
নেপথ্যের হোতাদের গ্রেফতার দেখতে চায় সাধারণ মানুষ
বৌদ্ধবিহার পোড়ানোর ঘটনায় রামুর বিক্ষুব্ধ মানুষ বিএনপি দলীয় এমপি ও আওয়ামী লীগ দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ডে দারুণ ক্ষুব্ধ। শতবর্ষী সীমা বৌদ্ধবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, 'জনপ্রতিনিধিরা আন্তরিক থাকলে রামুতে ইতিহাসের জঘন্যতম এ ঘটনা ঘটত না। উপজেলার শীর্ষ নেতারা রাত ১০টায় চৌমুহনী চত্বরের বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখলেও পরে মন্দির রক্ষা করতে তাদের কোনো ভূমিকা দেখিনি। অথচ প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা যদি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়েও থাকতেন তাহলে এত ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটত না।' স্থানীয় এমপিকে এ জন্য আসামি করা যৌক্তিক কি-না জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকার জন্য যদি কোনো মামলা হয় তবে আসামি করতে হবে রামুর সবাইকে।'
সাধারণ মানুষ মনে করে ঘটনার নেপথ্য নায়কদের খুঁজতে গিয়ে সরকার যদি কোনো পক্ষপাতিত্ব করে তবে পার পেয়ে যাবে আসল হোতারাই। এ ব্যাপারে কাউয়ারখোপ হাকিম রহীমা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুমথ বড়ূয়া বলেন, 'আমার স্কুলে আমিসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাত্র দু'জন শিক্ষক আছি। ঘর পোড়ানোর পর নিরাপত্তাহীনতার কারণে এখনও স্কুলে যেতে পারছি না আমি। অথচ জঘন্যতম এ ঘটনার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার না করে সরকার যদি বিষয়টিকে রাজনৈতিক রূপ দেয় তবে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে আবার।' একই অভিমত ব্যক্ত করলেন লালচিং বৌদ্ধবিহারের ভান্তে বঙ্কিম বড়ূয়া।
দলীয় কোন্দলে অসহায় ছিলেন শীর্ষ জনপ্রতিনিধিরা
এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান দু'জন দু'দলের হলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি রামুর তাণ্ডবলীলা। বর্তমান এমপি লুৎফর রহমান কাজল বিএনপির হলেও এলাকায় তার বিপক্ষে সক্রিয় আছে সাবেক বিএনপি দলীয় এমপি শহীদুজ্জামানের একটি গ্রুপ। একইভাবে আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজলের বিরোধী হিসেবে আছে তারই ভাই সাইমুম সরওয়ার কাজলের গ্রুপ। ক্ষমতায় থাকা এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান একত্র হয়ে বিক্ষোভ দমাতে চাইলেও বিভিন্ন মিছিলে দেখা গেছে বিবদমান গ্রুপের নেতাকর্মীদের। এ জন্য বিব্রত আছে প্রশাসনও।
Blogger Comment
Facebook Comment